প্রাকৃতিক সৌন্দের্য্যের লীলাভূমি রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। আর এই পার্বত্য জেলার অন্যতম জন গুরুত্বপূর্ন উপজেলা কাউখালী। ১৯৮২ সালের ১০ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার তৃতীয় ক্ষুদ্রতম উপজেলা হিসেবে কাউখালী উপজেলার আত্নপ্রকাশ করে।
পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে দশ ভাষাভাষি এগারটি জাতি সত্ত্বার বসবাস রয়েছে। এরা হচেছ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো, চাক, খিয়াং, খুমী, পাংখোয়া, বোম ও লুসাই। কাউখালী উপজেলায় মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৬০% উপজাতী এবং ৪০% বাঙ্গালী জনসংখ্যার বসবাস রয়েছে। উপজাতী জনগোষ্ঠীর মধ্যে চাকমা এবং মারমা (মগ) এ দু-গোএই প্রধান। তাছাড়া কিছু সংখ্যক ত্রিপুরা, রাখাইন ও তঞ্চঙ্গ্যাও বসবাস করে এ উপজেলায়। ভাষা ও সংস্কৃতির বিচারে এক জাতিসত্ত্বা অন্য জাতিসত্ত্বা থেকে স্বতন্ত্র। নৃতাত্ত্বিক বিচারে উপজতীয় জনগোষ্ঠীর সকলেই মঙ্গোলীয় জনগোষ্ঠিভুক্ত। সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিক থেকে ‘চাকমা’ হচেছ প্রধান জাতিসত্ত্বা। তাদের পরেই মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের অবস্থান। অন্যান্য সাতটি জাতিসত্ত্বার সংখ্যা অতি নগন্য।
এ অঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক জাতিসত্ত্বার রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি। এদের মধ্যে চাকমাদের রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। মারমারা বর্মী বর্ণমালায় লেখার কাজ চালায়। তাদের লোক সাহিত্যও বেশ সমৃদ্ধ। লোক সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে প্রবাদ-প্রবচন (ডাগকধা), ধাঁধাঁ (বানা), লোককাহিনী, ছড়া উভগীদ ইত্যাদি। এগুলোর ব্যবহার ও রচনা শৈলী বেশ চমকপ্রদ। লোককাহিনীর বুননেও উৎকর্ষতার ছাপ রয়েছে। চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরারা আধুনিক সাহিত্য চর্চায়ও অনেকটা এগিয়েছে। তারা নিজেদের ভাষায় কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি রচনা করছে।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের ভাষা সমগোত্রের এবং ভাষা রীতিতে বেশ মিল রয়েছে। দু’টো ভাষায় Indo-Aryanবা হিনদ-আর্য শাখার অন্তর্ভূক্ত। মারমারা বর্মী ভাষায় কথা বলে। মারমা এবং ম্রোদের ভাষা তিববতী-বর্মী ভাষার দলভুক্ত। ত্রিপুরা ভাষাকে ভারতবর্ষে ‘ককবরক’ নামে অভিহিত করা হয়। এ ভাষা ঝরহড়-Tibetanগোত্রভূক্ত।
সংস্কৃতি
পার্বত্য অঞ্চলের সংস্কৃতি অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং বৈচিত্রময়। এখানকার ১১টি জাতি সত্তার বিশাল সংস্কৃতির ভান্ডার রয়েছে। তারা পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতির ধারা পরম মমতায় যুগ যুগ ধরে রক্ষা করে চলেছে। আধুনিক শিক্ষা, মোঘল-ইংরেজ-বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়া, নগরায়ন ও আকাশ সংস্কৃতি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছে তা ঠিক। এতে তাদের ভাষা, পোশাক, আহার ও জীবন ধারায় পরিবর্তনও লক্ষনীয়। তা সত্ত্বেও সংস্কৃতির বিচারে তাদের এখনো আলাদাভাবে চেনা সম্ভব। এ ধারা আরো অনেকদিন অব্যাহত থাকবে তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাউখালী উপজেলার সংস্কৃতির দিকে ও অনেক শুনাম রয়েছে। এ উপজেলার সংকৃতির বিকশমান উন্নতিতে ইতিমধ্যে অনেকের নিকট সুনাম ও অর্জন করেছে। উপজাতি জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী ও বিভিন্ন পালা গান,জারী গান ও মঞ্চ নাটকের আয়োজন করে থাকে। তবে ধীরে ধীরে তা অনেকাংশ কমে আসছে। পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠির মধ্যে বৌদ্ধ, সনাতন, খ্রিস্টান ও ক্রামা ধর্ম প্রচলিত। এখানে আচার সংস্কার বিষয়ে বেশ কিছু টোটেমিক ধারণা প্রতিষ্ঠিত। মনিদরের পুরহিতদের পাশাপাশি পাহাড়ি ওঝা, বৈদ্য ও তান্ত্রিকদের প্রভাবও লক্ষ করা যায়। সমাজে প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন রীতিনীতি মেনে চলে সবাই। লোক সংস্কার ও লোক বিশ্বাসকে মনে প্রাণে ধারণ করে সেটা থেকে শুভ-অশুভকে বিচার করা হয় কখনও কখনও। তবে বর্তমানে কুসংস্কারগুলো ধীরে ধীরে কমে যাচেছ।
পোশাক-পরিচছদ ও অলংকার ব্যবহারের ক্ষেত্রে পার্বত্য আদিবাসীদের শিল্পমননশীলতার পরিচয় মেলে। চাকমাদের পিনন-খাদি, মারমাদের লুঙ্গি-থামি, উৎকৃষ্ট শিল্পকলার পরিচয় বহন করে। বর্তমানে পেশাক-পরিচছদে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এখন সকল জাতিসত্তার মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি-ব্লাউজ এবং পুরুষদের পেনট-শার্ট পরতে দেখা যায়।
চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যাদের দু’টি জনপ্রিয় পালাগানের নাম হলো ‘রাধামন-ধনপুদি পালা’ ও ‘চাদিগাং ছারা পালা’। যুবক-যুবতীদের মধ্যে ‘উভগীদ’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। অতীতে মুহুর্মুহু রেইঙের মধ্যে সারারাত ব্যাপী গেইংখুলির পালাগান শোনা ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। কাউখালী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মারমা জনগোষ্ঠীল আধিক্য থাকায় শীত মৌসুমে সারারাত ব্যাপী যাত্রা পালার আয়োজন করে থাকে।এছাড়া মারমাদের ঐতিহ্যবাহি পানি উৎসব এখন সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হচ্ছে। মারমাদের গীতি-নৃত্য-নাট্য বৌদ্ধ ধর্মীয় দর্শনের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বিজু-সাংগ্রাই-বৈসুক’। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও তঞ্চঙ্গ্যারা বর্ষ বিদায় ও নববষের্র আগমণ উপলক্ষে তিনদিনব্যাপী এ উৎসব পালন করে। এ বিষয়ে ‘ঐতিহ্য’ নামক কনটেনেট বর্ণনা করা হয়েছে। চাকমাদের ‘হাল পালানী’ উৎসব কৃষি ভিত্তিক। এ সময় হালচাষ বন্ধ রাখা হয় ঋতুমতী জমির উব্ররা শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে। মারমাদের ‘ছোয়াইংদগ্রী লং পোয়েহ’ ও ‘রথটানা’ উল্লেখযোগ্য। ‘খিয়াং উপজাতিদের প্রধান উৎসব ‘হেনেই’। আর ‘লুসাইদের নবান্ন উৎসবের নাম ‘চাপ চার কুট’। ম্রোদের রয়েছে ‘গো-হত্যা’ উৎসব। বর্তমানে ‘কঠিন চীবর দান’ প্রধান ধর্মীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। চাকমাদের জনপ্রিয় নৃত্য হচেছ ‘জুমনৃত্য’। ত্রিপুরাদের ‘গরাইয়া নৃত্য’ বৈসুক উৎসবে অনুষ্ঠিত হয়। উপজাতীয় নৃত্য শিল্পীদের ‘জুম নৃত্য’, ‘গরাইয়া নৃত্য’, ‘বাঁশ নৃত্য’ ও ‘বোতল নৃত্য’ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রচুর প্রশংসা কুড়িয়েছে।
এতদঞ্চলের সাহিত্য চর্চার শুরু ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে রাজবাড়ি কেনিদ্রক ‘গৈরিকা’ সাময়িকীকে ঘিরে। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বানদরবান থেকে ‘ঝরণা’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে। বিরাজ মোহন দেওয়ান সম্পাদিত ‘পার্বত্য বাণী’ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় যারা নিয়মিত লিখতেন তারা হলেন রাজমাতা বিনীতা রায়, সলিল রায়, মুকুনদ তালুকদার, ভগদত্ত খীসা, সুনীতি জীবন চাকমা, কুমার কোকনাদাক্ষ রায়, অরুন রায়, বঙ্কিম কৃষ্ণ দেওয়ান প্রমুখ। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘সাপ্তাহিক বনভূমি’ নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। ‘দৈনিক গিরিদর্পন’ পত্রিকার আত্নপ্রকাশ ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে ‘সাপ্তাহিক রাঙামাটি’ এর প্রকাশনা শুরু। এটি ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে দৈনিকে উন্নীত হয়। ১৯৯১ সালে কাউখালী উপজেলা থেকে পাক্ষিক অদিতি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হলে ও কয়েকদিন পর তা বন্ধ হয়ে যায়। পার্বত্যাঞ্চলের জাতিসত্তাসমূহের নিজস্ব সাহিত্য রয়েছে। তাদের লোক সাহিত্য নানা কারণে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস